শিক্ষক দিবস
ঘটনা ১
ইমরান একজন মেধাবী ছাত্র। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত ফার্স্ট হওয়ার কৃতিত্ব তার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি। পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে সে কুরআনে কারীম হেফজ করাও শুরু করল। শিক্ষকগণ তার প্রতি অত্যন্ত খুশি। শিক্ষক মিটিংয়ে প্রায়ই তার আলোচনা হয়ে থাকে। তাদের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রটির হঠাৎ করে সবকিছু বদলে গেল। সকলের প্রিয় ইমরান ধীরে ধীরে সকলের বিরক্তিতে পরিণত হলো।
এখন আর সে ভালো করে পড়াশোনা করে না। রোল নং এক থেকে বিশে নেমে গেল। যথা নিয়মে শিক্ষকগণ তাকে শাসন করতে লাগলেন। দিন দিন শাসনের মাত্রা বাড়াতে থাকলেন। শাসনের মাত্রা বাড়ছিল। কিন্তু ইমরানের কোন পরিবর্তন ঘটছিল না।
আমাদের ইন্সট্রাক্টর মাওলানা আলাউদ্দিন রফিক সাহেব তখন সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসচিব। তিনি নিয়মিত শিক্ষকদেরকে ট্রেনিং করাচ্ছিলেন। ট্রেনিং এর একটি সেশনে সেই ছাত্রের কথাও আলোচনায় আসল। ইমরানের শিক্ষক ট্রেনিং থেকে জানলেন, একজন ছাত্রের মাঝে কখনো কখনো আচরণগত পরিবর্তন তৈরি হতে পারে। তখন তার ডায়াগনস্টিক টেস্ট করতে হয়। আমরা পপুলার, ল্যাবএইড কিংবা এ ধরনের কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর কথা বলছি না। আমরা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রের মানসিক ডায়াগনস্টিক টেস্টের কথা বলছি।
ইমরানের শিক্ষক নতুন করে ভাবলেন। তিনি তার আচরণ পরিবর্তন করলেন। তিনি ভুল বুঝতে পারলেন। আস্তে আস্তে গল্পের ছলে ইমরানের সাথে মিশে গেলেন। জানতে পারলেন, অল্প কিছুদিন আগে তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। প্রতিদিন বিকালে সে বাসায় যায়। অসুস্থ বাবাকে দেখে এবং কান্নাকাটি করে। এভাবেই সে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। পড়াশোনায় এখন আর তার মন বসে না। পড়তে বসলে তার কল্পনায় শুধু বাবার বিছানায় পড়ে থাকা ছবিটাই ভেসে ওঠে।
ইমরানের শিক্ষক আমাদের এই কোর্সের ইন্সট্রাক্টর মাওলানা আলাউদ্দিন রফিক সাহেবের পরামর্শে আবার নতুন করে চেষ্টা শুরু করলেন। অনেক দিন মেহনত চলল। একসময় ইমরান আবার নিজেকে রিকভারি করতে সক্ষম হল। সে আগের অবস্থানে ফিরে আসতে সক্ষম হল।
এসব কিছুই সম্ভব হয়েছিল, ইমরানের মানসিক ডায়াগনস্টিক টেস্ট করে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করার ফলে।
একজন শিক্ষক কিংবা বাবা-মা হিসেবে আপনার কাছে প্রশ্ন, আপনার ছাত্র, সন্তান, ছোট ভাই-বোন কিংবা ভাতিজা-ভাগিনার আচরণগত পরিবর্তনের পর আপনার আচরণ কেমন হয়? আপনি কি তার ডায়াগনস্টিক টেস্ট করেন? কিভাবে তার রিকভারি করা সম্ভব সেটা কি জানেন?
ঘটনা ২
রাশেদ সাহেব একটি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক। তার স্কুলের একজন শিক্ষার্থী কবির এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রাথমিক যাচাই পরীক্ষায় সে দুইটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। ফলে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হয়।
রাশেদ সাহেব তাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন, আমি জানি তুমি চেষ্টা করলে এসএসসি পরীক্ষায় A+ পেতে পারো। তুমি যদি আমাকে কথা দাও যে, তুমি ভালোভাবে প্রস্তুতি নেবে। তাহলে আমি তোমাকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতির জন্য প্রধান শিক্ষকের নিকট সুপারিশ করব। কবিরের বাবা মারা গেছে প্রায় এক বছর হয়। কেউ তাকে এমন আপন করে কথা বলেনি।
শিক্ষকের এমন মমতামাখা কথা তার হৃদয় স্পর্শ করল। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। দু‘গাল বেয়ে অশ্রুর ফোঁটাগুলো পড়তে লাগল। সে রাশেদ স্যারকে কথা দিল, সে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেবে। এসএসসি পরীক্ষায় A+ পাবে।
রাশেদ সাহেবের সুপারিশে প্রিন্সিপাল সাহেব তাকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিলেন। কবির সত্যি সত্যি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ 5 পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হল। স্কুলের সবাই অবাক হয়ে গেল। কেউ ভাবেনি সে পাশ করবে। সেই কবিরই কিনা A+ পেয়ে উত্তীর্ণ হল।
সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল, তার এই সফলতার রহস্য কী? তার উত্তর ছিল, রাশেদ স্যারের উৎসাহই আমাকে এই সফলতা এনে দিয়েছে।
ঘটনা ৩
জনাব আজমল সাহেবের ছোটবেলা থেকে বড় একটা স্বপ্ন ছিল। তিনি শিক্ষক হবেন। ছোটবেলায় শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি তার মনে খুব দাগ কেটেছিল। বাদশাহ আলমগীরের শাহজাদা শুধু শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিল। কিন্তু সে নিজে কেন শিক্ষকের পা ডলে ধুয়ে দিল না সেজন্য বাদশা শিক্ষককে বলেছিলেন, তার তো আদব-কায়দা শিক্ষা হয়নি। সেদিন শিক্ষকের মনটা তখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল।
কবি কাদের নেওয়াজ এ দৃশ্য ফুটিয়ে তুলে লিখেছেন,
আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।
সে সময় থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বড় হয়ে শিক্ষক হবেন। আজ তার জীবনের সেই সময় উপস্থিত। তিনি এখন শিক্ষক। তার সামনে প্রতিদিন উপস্থিত হয় অনেক ছাত্র। কিন্তু তিনি বড় একটি সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন।
ক্লাসে গিয়ে প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। কোন একজন ছাত্র অন্যকে ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে। কেউ কারো জামায় দাগ দিয়ে দিয়েছে। কেউ বা ক্লাসের সময় অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। পুরো ক্লাসের বড় অংশ বাচ্চাদের অভিযোগ শুনতে শুনতেই শেষ হয়ে যায়। একদিন তো এক ছাত্র ডাস্টার ছুড়ে মেরে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিল।
কয়েকদিন যাবত আজমল সাহেব খুব ভাবছেন। কিন্তু তিনি কোনভাবেই তাদেরকে ম্যানেজ করতে পারছেন না। তিনি কী করতে পারেন? কিভাবে শান্তভাবে এর সমাধান করতে পারেন? এই সমস্যার কি আসলেই কোন সমাধান আছে?
উপরের তিনটি ঘটনা থেকে আমরা কি বুঝতে পারলাম !
সঠিক দক্ষতা প্রয়োগ করা হলে একজন শিক্ষক হিসাবে সফল হওয়া অনেক গুণ সহজ হয়।
সফল শিক্ষক হতে হলে প্রয়োজন একাডেমিক দক্ষতার পাশাপাশি শিক্ষকতার বিশেষ দক্ষতাগুলোও অর্জন করা। একাডেমিক দক্ষতা হয়তো অনেকেরই থাকে। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে যে দক্ষতা ও গুণগুলো থাকা দরকার সেগুলো খুব কম শিক্ষকেরই থাকে।